সোমবার ২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম >>
শিরোনাম >>
ডয়চে ভেলের প্রতিবেদন

ধনীদের ৮৭ ভাগই আয়কর দেয় না

অনলাইন ডেস্ক   |   সোমবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪   |   প্রিন্ট   |   68 বার পঠিত

ধনীদের ৮৭ ভাগই আয়কর দেয় না

প্রতীকী ছবি

ধনী এবং উচ্চ মধ্যবিত্তদের শতকরা ৮৭ ভাগই আয় কর দেন না বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। তারা বলছে, কর প্রশাসনের অদক্ষতা ও কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশ করে তারা এই কর ফাঁকি দিচ্ছেন। এ কারণে কখনোই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারে না।

এনবিআরের সঙ্গে প্রাক-বাজেট বৈঠকে অর্থনীতি সমিতি জানায়, এ দেশে ১৮ লাখ মানুষ কর দেন। তাদের মধ্যে ১০ লাখ সরকারি চাকরিজীবী এবং অন্যান্য চাকরিতে নিয়োজিত আছেন। আমাদের হিসাবে, দেশে ধনী ও উচ্চমধ্যবিত্তদের মধ্যে আয়কর দেওয়া লোকের সংখ্যা ৯-১০ লাখ হবে। এই সংখ্যা হওয়ার কথা ৭৮ লাখ ৩২ হাজার। এর মানে, ধনী ও উচ্চমধ্যবিত্তদের ৮৭ শতাংশ কোনো ধরনের আয়কর দেন না।

অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম সোমবার ডয়চে ভেলেকে বলেন, আমরা গবেষণায় ওই তথ্য পেয়েছি। এ দেশে এমনিতেই মানুষের মধ্যে আয়কর দেওয়ার প্রবণতা কম। আর উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তের মধ্যে এটা আরও কম। যারা দেয় না সেই ৮৭ ভাগের কাছ থেকে আয়কর আদায় করতে পারলে রাজস্ব ঘাটতি থাকতো না।

এনবিআর কখনোই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জন করতে পারে না। আইএমফের ঋণের শর্তের মধ্যে অন্যতম হলো রাজস্ব আদায় বাড়ানো এবং কর প্রশাসনের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি। কিন্তু চলতি অর্থবছরেও এনবিআর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রা কমানোয় এখন তা দাঁড়ালো চার লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা।

অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি হয়েছে ২৩ হাজার ২২৭ কোটি টাকা। এই প্রেক্ষাপটে রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা কমানো হলেও তা অর্জন করা শেষ পর্যন্ত সম্ভব হবে না বলে মনে কছেন বিশ্লেষকেরা। বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ কর মোট করের শতকরা ৩০ ভাগ, বাকি ৭০ ভাগ পরোক্ষ। এই পরোক্ষ করের চাপ সবচেয়ে বেশি দেশের সাধারণ মানুষের ওপর।

কিন্তু অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, প্রত্যক্ষ কর সবার শীর্ষে থাকা উচিত। সেটা হলো আয়কর। যেটা ব্যক্তির আয়ের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু বাংলাদেশে উল্টো ঘটনা ঘটছে। আর এখানে কর জিডিপি অনুপাত এখনো ১০ শতাংশের ঘরে- যা এশিয়ায় সর্বনিম্ন।

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমান বলেন, এর আগে অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাত বলেছিলেন মানুষ সিন্দুকে কোটি কোটি টাকা রেখে দিয়েছে। পরে অভিযান চালিয়ে তার প্রমাণ পায়া যায়। এনু-রুপনের বাড়ি থেকে সিন্দুকভর্তি টাকা উদ্ধার করা হয়। এবার অর্থনীতি সমিতি বলছে ৮৭ ভাগ ধনী এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত আয়কর দেয় না। সংখ্যাটা কত ভাগ হবে সেই জরিপ আমি করিনি। তবে আমার অভিজ্ঞতা হলো অধিকাংশই দেয় না।

অধ্যাপক মো. আইনুল ইসলাম বলেন, ধনী যারা আয়কর ফাঁকি দেন তাদের ব্যাংক হিসাবে অর্থ থাকলেও তা দেখান না। আর এ জন্য ব্যাংক এবং এনবিআরের এক শ্রেণির কর্মকর্তা সুবিধার বিনিময়ে তাদের সহায়তা করেন। আর তাদের আয়ের একটি অংশ তারা ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে রেখে দেশের বাইরে পাচার করেন। কিন্তু এটা চিহ্নিত করা কোনো কঠিন কাজ না। নানা টুলস আছে, সেগুলো ব্যবহার করলেই চিহ্নিত করা যায়। এখানে এনবিআর আগ্রহ দেখায় না। আবার যারা ফাঁকি দেয়, তারা নানাভাবে প্রভাশালী।

তার ভাষায়, দেশে যাদের টিআইএন নাম্বার আছে, তাদের সবার কাছ থেকে কর আদায় করতে পারলেও ঘাটতি থাকে না। সেটা না করে এনবিআর পরোক্ষ কর বাড়ায়। নিত্য ব্যবহারের পণ্যের ওপর এই কর দেশের সাধারণ মানুষকে দিতে হয়। আর যারা ধনী তারা রেহাই পেয়ে যান।

এ জন্য অর্থনীতি সমিতি দেশে ট্যাক্স কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। যেখানে কর যারা বোঝেন, সেরকম বিশেজ্ঞ পর্যায়ের ব্যক্তিরা থাকবেন। লেনদেন যত দ্রুত সম্ভব ডিজিটাল করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। আর ওই পদ্ধতির সঙ্গে এনবিআর যুক্ত থাকলে সবার আয় ব্যয়ের খবর তারা পাবেন, চিহ্নিত করতে পারবেন।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ২০১৮ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে বছরে কোটি টাকা আয় করেন এরকম জনগোষ্ঠীর ৬৭ শতাংশ কর আওতার বাইরে আছে। এরা যে লার্জ ট্যাক্সপেয়ার ইউনিটের মধ্যে তা নয়, এরা সারাদেশেই ছড়িয়ে আছেন। কিন্তু এদের করের আওতায় আনা যাচ্ছে না।

বদিউর রহমান বলেন, রাষ্ট্রযন্ত্র ফেয়ার না হলে ধনীদের কাছ থেকে আয়কর আদায় সম্ভব নয়। কারণ তারা প্রভাশালী, তারা রাষ্ট্রযন্ত্রেও সঙ্গে যুক্ত। তাদেরকে ছাড় দেওয়া হয়। দেশে গ্রাম পর্যন্ত এখন বহু লোক গাড়ি-বাড়ি হাঁকায়, কিন্তু তারা আয়কর দেয় না।
তিনি বলেন, আমি যখন এনবিআরের চেয়ারম্যান, তখন ওয়ান ইলেভেন সরকার। তখন একবার উদ্যোগ নিয়েছিলাম, কিন্তু আমাকে সেই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে দেওয়া হয়নি। আমি গুলশান-বনানী-ধানমন্ডি এলাকায় ট্যাক্স বুথ বসিয়ে আয়কর আদায়ের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। পদ্ধতিটি ছিল- এনবিআর, পুলিশ ও স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সমন্বয়ে টিম করে বাড়ি বাড়ি যাওয়া। কত বাসা ভাড়া দেন তা জানা। তো এখন থেকে ১৭ বছর আগে যদি কেউ ২০ হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিয়ে থাকেন তাহলে তার আয় কত তা বুঝতে অসুবিধা ছিল না। আমি চেয়েছিলাম তাৎক্ষণিক টিআইএন নাম্বার দিতে। কিন্তু আমাকে থামিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে যদি সারাদেশে জরিপ করা হয়, তাহলে যারা আয়কর ফাঁকি দেয় তাদের চিহ্নিত করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। তার কথা, ওই সময়ে নির্দলীয় সরকার ছিল, তারপরও আমাকে করতে দেওয়া হয়নি। এখন তো দলীয় সরকার, তাহলে সেটা কীভাবে সম্ভব?
এই দু’জন বলেন, আয়কর ঠিকমতো আদায় হলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি কর আদায় হতো। সেটা না করে যারা কর দেন তাদের উল্টো নানা হয়রানি করা হয়। আর গরিব মানুষের ওপর করের বোঝা চাপানো হয়। এ দেশে যাদের সম্পদ বেশি, তারা কম কর দেয়। যাদের নেই, তারা বেশি কর দেয়।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশ ফেলো অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রত্যক্ষ কর (আয়কর) বাড়ানো গেলে আমাদের এখন যে কর জিডিপি অনুপাত ৮.৫ শতাংশ আছে, তা বেড়ে যাবে। তাই অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন ও বাজেট ঘাটতি কমাতে যারা আয়কর দেওয়ার যোগ্য হওয়ার পরও আয়কর দেন না, তাদের কর আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। যারা কর ফাঁকি দেন, তাদের কর দিতে বাধ্য করতে হবে। এ জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে, আইন প্রয়োগ করতে হবে। শাস্তি ও প্রণোদনা দুটোই দিতে হবে। প্রত্যক্ষ করই উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে। এটাই সবচয়ে বেশি হওয়া উচিত। তার কথা, পরোক্ষ করের চাপ সাধারণ মানুষের ওপর বেশি পড়ে। তাদের আয় কম, ফলে চাপ বাড়ে। তাই এনবিআরের প্রত্যক্ষ কর আদায়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের বাংলা সংস্করণের হয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন হারুন উর রশীদ স্বপন। এই প্রতিবেদনের সব ধরনের দায়ভার ডয়চে ভেলের।

Facebook Comments Box

Posted ১১:৩২ অপরাহ্ণ | সোমবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

ajkersangbad24.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

সম্পাদক
ফয়জুল আহমদ
যোগাযোগ

01712000420

fayzul.ahmed@gmail.com