মাওলানা মুফতি মো. আবু সাঈদ সৈয়দ | বৃহস্পতিবার, ০৬ জুন ২০২৪ | প্রিন্ট | 79 বার পঠিত
জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনের গুরুত্বপূর্ণ আমল- ১) জিলহজের প্রথম ৯ দিন রোজা রাখা; বিশেষত আরাফার দিনের রোজা:
নবিজির (স.) স্ত্রী (হযরত হাফসা রা.) বর্ণনা করেন, হযরত রাসুল (স.) জিলহজ মাসের ৯ দিন, আশুরার দিন এবং প্রতি মাসের তিন দিন রোজা রাখতেন। [ইমাম নাসায়ি, আস-সুনান: ২৪১৭; হাদিসটি সহিহ]
অন্য হাদিসে হযরত নবি কারীম (স.) বলেন, আরাফার দিনের রোজার বিষয়ে আমি আল্লাহর নিকট আশা করি যে, তিনি এর দ্বারা বিগত বছর ও আগামী এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন। [ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ২৬৩৬]
২) সামর্থ্যবান হলে কুরবানি করা:
হযরত রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করলো না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে। [ইমাম ইবনু মাজাহ, আস-সুনান: ৩১২৩; হাদিসটি হাসান]
৩) এই দশ দিন নখ ও চুল না কাটা:
হযরত নবি কারীম (স.) বলেন, তামাদের কেউ জিলহজ মাসের চাঁদ দেখলে এবং কুরবানি করার ইচ্ছা করলে, সে যেন তার চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকে। [ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ৫০১৩]
আরেকটি বর্ণনায় এসেছে, শরীরের কোনো তক বা চামড়াও যেন স্পর্শ না করে; অর্থাৎ না উঠায় বা না ছিঁড়ে (হোক সেটি ফাটা বা মরা)। [ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ৫০১১]
সুতরাং, হাদিস থেকে জানা গেলো, জিলহজ মাস শুরু হয়ে গেলে কুরবানি দাতা ১০ তারিখের আগে চুল, নখ,পশম কাটবেন না; এমনকি তকও স্পর্শ করবেন না। তবে, অন্য হাদিস থেকে বোঝা যায়, যারা কুরবানি দেবে না, তারাও এই হুকুমের অন্তর্ভূক্ত। বিশেষত কুরবানিদাতার ক্ষেত্রে এগুলো না কাটার এই হুকুমকে কোনো কোনো আলিম ‘ওয়াজিব’ বলেছেন, আবার অনেকে ‘মুস্তাহাব’ বলেছেন।
হযরত রাসুল (স.) বলেন, “আমি কুরবানির দিন সম্পর্কে আদিষ্ট হয়েছি। আল্লাহ তা’আলা তা এই উম্মতের জন্য ঈদ হিসেবে নির্ধারণ করেছেন।’’ এক ব্যক্তি বললো, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ্! যদি আমার কাছে শুধু একটি মানিহা থাকে (অর্থাৎ, অন্যের থেকে নেওয়া দুগ্ধ দানকারী একটি উটনী থাকে—তবুও কি কুরবানি দিতে হবে?)’
হযরত নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘‘না; বরং সেদিন (অর্থাৎ, ঈদের দিন) তুমি তোমার চুল কাটবে, নখ কাটবে, গোঁফ ও নাভীর নিচের পশম পরিষ্কার করবে। এটাই আল্লাহ তা’আলার কাছে তোমার পূর্ণ কুরবানি বলে গন্য হবে। [ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ: ৬৫৭৫; ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান: ২৭৮৯; ইমাম হাকিম, ইবনু হিব্বান, মুনযিরি, তাবারানি, যাহাবি,শুয়াইব আরনাউত্ব (রহ্)-সহ মুহাদ্দিসগণ হাদিসটির সনদ হাসান (গ্রহণযোগ্য) বলেছেন]
এই হাদিসে ঈদের দিনে নখ ও চুল কাটতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ, প্রথম ৯ দিনে না কেটে একেবারে ঈদের দিনে কাটলে আল্লাহর নিকট পূর্ণ কুরবানির নেকি পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ।
সুতরাং, আমাদের মধ্যে যারা কুরবানি দেবে আর যারা দেবে না, সবাই জিলহজ মাসের চাঁদ দেখার আগেই নখ ও চুল কেটে নেবো।
এরপর এই ৯ দিন নখ ও চুল না কেটে আরেকবার ঈদের দিন পশু জবাইয়ের পরে কোনো একসময় কাটবো, ইনশাআল্লাহ। ধরুন, দুপুরের পর হতে পারে।
৪) চার ধরনের যিকরে লেগে থাকা:
হযরত রাসুল (স.) বলেন, আল্লাহ তা‘আলার নিকট জিলহজের দশ দিনের আমলের চেয়ে মহান এবং প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই।
সুতরাং, তোমরা সেই দিনগুলোতে অধিক পরিমাণে তাসবিহ (সুবহানাল্লাহ), তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ), তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্) ও তাকবির (আল্লাহু আকবার) পড়ো। [ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ: ৫৪৪৬; হাদিসটির সনদ সহিহ]
৫) বিশেষ করে বেশি বেশি তাকবির তথা আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা করা:
সাধারণভাবে এই দশ দিন সংক্ষেপে ‘আল্লাহু আকবার’ বেশি বেশি পড়ুন। সাথে, নিচের বাক্যগুলোও সাধ্যানুসারে পড়ুন।
আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার; লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার; ওয়া লিল্লাহিল হামদ। (আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ; আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ; আল্লাহ ছাড়া কোনও উপাস্য নেই।
আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ; আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ; আর আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা)
এটি প্রখ্যাত সাহাবি হযরত ইবনু মাস‘উদ (রা.) ও অন্যান্য পূর্বসূরিদের থেকে প্রমাণিত।
তবে, আরাফার দিন অর্থাৎ জিলহজের ৯ তারিখ ফজর থেকে শুরু করে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর একাকী বা জামাতে নামাজ আদায়কারী, নারী অথবা পুরুষ—প্রত্যেকের জন্য একবার তাকবিরে তাশরিক (উপরে বর্ণিত তাকবিরটি) পাঠ করা ওয়াজিব। পুরুষরা উচ্চ আওয়াজে বলবে, আর নারীরা নিচু আওয়াজে।
৬) চারটি সম্মানিত মাসের একটি হলো জিলহজ; তাই এই মাসের সম্মানে যথাসম্ভব সকল গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা।
৭) এই দিনগুলো বছরের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ,তাই অধিক পরিমাণে নেক আমল করা।
এই দশদিনের ফরজ ইবাদত অন্যান্য মাসের ফরজ ইবাদতের তুলনায় অধিক মর্যাদার।এই দশদিনের নফল ইবাদত অন্যান্য মাসের নফল ইবাদতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। [ইমাম ইবনু রজব,ফাতহুল বারি ৯/১৫]
আমরা কী কী আমল আমরা করতে পারি?
(এখন যে আমলগুলোর কথা বলা হবে, সেগুলো বছরের যেকোনো সময়ের জন্য। বিশেষভাবে জিলহজ মাসের জন্য নির্ধারিত নয়)
বেশি বেশি ইস্তিগফার পাঠ করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যে গুনাহ করবে অথবা নিজের উপর জুলুম করবে,অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা (ইস্তিগফার) করবে,সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল,দয়াময় পাবে। [সুরা নিসা ১১০]
আন্তরিকভাবে তওবাহ করা:
আল্লাহ্ বলেন, অবশ্যই আল্লাহ তাদের তাওবাহ কবুল করবেন, যারা ভুলবশত মন্দ কাজ করে,অতঃপর দেরি না করেই (দ্রুত) তাওবাহ করে। এরাই হলো সেসব লোক, যাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। [সুরা নিসা ১৭]
অধিক পরিমাণে দরুদ পাঠ করা:
হযরত রাসুল (স.) বলেন, যে ব্যক্তি আমার প্রতি একবার দরুদ পাঠ করবে, আল্লাহ তার প্রতি ১০ বার রহমত বর্ষণ করবেন, ১০টি গুনাহ মোচন করবেন এবং তার জন্য ১০টি স্তর উন্নীত করবেন। [ইমাম নাসায়ি, ১২৯৭; ইমাম ইবনু হিব্বান:৯০৪; হাদিসটি সহিহ]
সাধ্যানুযায়ী দান-সদাকাহ করা:
হযরত নবি করিম (স.) বলেন, প্রত্যেক ব্যক্তি (হাশরের মাঠে) তার সদাকার ছায়াতলে থাকবে, যতক্ষণে লোকদের মাঝে ফয়সালা শেষ না হবে। [ইমাম আহমাদ, ১৭৩৩৩, সহিহুত তারগিব: ৮৭২;হাদিসটি সহিহ]
কুরআন তিলাওয়াত করা:
হযরত রাসুল (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি রাতে ১০০ আয়াত তিলাওয়াত করবে,তাকে (আল্লাহর) আনুগত্যশীল বান্দাদের মাঝে লিপিবদ্ধ করা হবে। [ইমাম আহমাদ,১৬৯৫৮;,সিলসিলা সহিহাহ: ৬৪৩;হাদিসটি সহিহ]
সুরা ইখলাস বেশি করে পড়া:
হযরত রাসুল (স.) বলেছেন, যাঁর হাতে আমার জীবন, তাঁর কসম করে বলছি, নিশ্চয়ই এই সুরা ইখলাস কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান। [ইমাম বুখারি, ৫০১৩]
এছাড়াও আমরা আরও যা করতে পারি:
* সামর্থ্য থাকলে হজ ও উমরা আদায় করা;
* বেশি বেশি দু‘আ করা;
* মা-বাবার যথাসাধ্য খেদমত করা;
* শেষ রাতে তাহাজ্জুদ আদায় করা;
* অসুস্থ ব্যক্তির সেবা-সুশ্রূষা করা;
* মানুষের অভাব ও প্রয়োজন মেটানো;
* সকাল-সন্ধ্যা ও ঘুমের আগের আমলগুলো গুরুত্বের সাথে আদায় করা।
লেখক : সুপার, হাতিয়া, নাচনী, বেতাউকা পীর আকিল শাহ নেছারিয়া হাফিজিয়া দাখিল মাদরাসা, দিরাই, সুনামগঞ্জ।
Posted ১০:২১ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৬ জুন ২০২৪
ajkersangbad24.com | Fayzul Ahmed