সোমবার ২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম >>
শিরোনাম >>

জগন্নাথপুরের যুবক অমানবিক নির্যাতনের পর ৪৫ লাখ খুইয়ে লিবিয়া থেকে পালিয়ে বাঁচল

জগন্নাথপুর প্রতিনিধি   |   শনিবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩   |   প্রিন্ট   |   148 বার পঠিত

জগন্নাথপুরের যুবক অমানবিক নির্যাতনের পর ৪৫ লাখ খুইয়ে লিবিয়া থেকে পালিয়ে বাঁচল

ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে লিবিয়ায় যান মামুনুর রহমান (৩৪)। সেখানে মাফিয়া চক্রের জালে ফেঁসে গিয়ে ভয়ঙ্কর মৃত্যুর মুখে পড়েন। ইউরোপের স্বপ্ন তখন হয়ে উঠে দুঃস্বপ্ন। জিম্মিখানা নামক টর্চারসেলে প্রায় দুইবছর কাঁটল বন্দিজীবন। অমানবিক নির্যাতনে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল জীবন। ধার কর্জ ও বসতবাড়ি বন্ধক রেখে ৪৫ লাখ টাকা খুইয়েও মিলেনি মুক্তি কিংবা ইতালি যাওয়া। যন্ত্রণার জীবন আকাশে হঠাৎ যেন মুক্তির তাঁরার দেখা মিলল। সেই সুযোগে জীবনবাজী রেখে পালিয়ে জঙ্গলে লুকিয়ে জীবন রক্ষা করলেন যুবক।
বৃহস্পতিবার (২১ ডিসেম্বর) বিকেলে স্থানীয় সাংবাদিকদের এসব কথা জানান ভুক্তভোগী ওই যুবক।
মামুনুর রহমানের বাড়ি সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর পৌরশহরের ইকড়ছই এলাকা। তিনি মৃত মতিউর রহমানের ছেলে। গত ১১ নভেম্বর লিবিয়া থেকে নিঃস্ব হাতে বাড়ি ফিরেছেন মামুনুর। এবিষয়ে জগন্নাথপুর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন তিনি।
নির্যাতনের শিকার মামুনুর রহমান জানালেন, ২০২১ সালের এপ্রিল মাসের দিকে জগন্নাথপুরের আলাগদি গ্রামের মানব পাচারকারী মুজিবুর রহমানের প্ররোচণায় সাড়ে ৮ লাখ টাকার চুক্তিতে ইতালি যাওয়ার জন্য লিবিয়াতে যান। লিবিয়ায় পৌছে ওই দালালকে ৪ লাখ টাকা দেন। সেখানে দুইমাস অতিবাহিত হওয়ার পর জাহেদ নামের এক দালালের ক্যাস্পে পাঠানো হয়। কিছুদিন পরে আমিনুল ও রাজ্জাক দালালের আস্তানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরকম কয়েকটি ক্যাস্পে তাকে রাখা হয়। এসব ক্যাম্পে জিম্মি করে গেমের কথা বলে মুজিবুর আরো ৬ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়।
৫ মাস পর একরাতে গেমের কথা বলে নৌকা তোলা হয়। কিছুক্ষণ সাগরে ঘোরাঘুরির পর তুলে দেয়া হয় লিবিয়ার পুলিশের হাতে। সেখানে ছোট একটি বন্ধি ঘরে আমরা ২০০ জন ছিলাম। ওই ঘরের সঙ্গে থাকা বাথরুমের পয়নিস্কাশনের ময়লা আবর্জনার পানি জিম্মিঘরে ভেসে এসে হাঁটু সমান পানি জমে ছিল। শ্বাস নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল দমবন্ধ হয়ে মরে গিয়ে বেঁচে গেছি।
একদিন, একরাত থাকার পর কদ্দুস নামের আরেক দালালের মাধ্যমে ৫ লাখ টাকা দিয়ে মুক্ত হই।
ওই যুবক বলেন, লিবিয়ার অবস্থানরত প্রতিটি মাফিয়াচক্রের সঙ্গে দেশীয় দালালদের যোগসূত্র রয়েছে। তারা মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে বিপদগ্রস্থ ব্যক্তি ও স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুক্তির আশ্বাস ও ইউরোপের স্বপ্ন দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা লুটে নেয়।
মামুনুর জানান, পুলিশের বন্দিখানা থেকে বের হওয়ার পর ফের ইতালি পাঠানোর কথা বলে, জগন্নাথপুরের বালিকান্দি গ্রামের রাসেল ৯ লাখ হাজার টাকা নিয়ে এনাম দালালের মাধ্যমে লিবিয়ার মাফিয়া চক্রের কাছে বিক্রি করে দেয়। ওই মাফিয়ার বন্দিঘরে এক বিভিষিকাময় পরিস্থিতি ছিল। একটি ভবনের এক কক্ষে ১২০০ অভিবাসনদের সঙ্গে আমাকেও রাখা হয়। কারো সঙ্গে কথা বলতে দেয়া হতো না।কথা বললে মারধর করা হতো। ঘুমানোর কোন ব্যবস্থা নেই। একজন আরেক জনের গায়ের উপর মাথা রেখে ঘুমাতাম। এ জিম্মিখানায় সকালে একটি রুটি আর রাতে খিছুরি দেয়া হতো। তাও একটি তালায় সামান্য খিছুরি পাঁচজন মিলে খেতাম। কোনো কোনো দিন উপোষ রাখা হতো। এখানে বন্দি হওয়ার পর টানা ৯ দিন পরিবারের লোকজন সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। টাকার জন্য রশি দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে লোহার পাইপ দিয়ে পেটাতো মাফিয়া। চোখের সামনে অনেককে মৃত্যু কুলে ঢলে পড়তে দেখেছি।
জিম্মিদশায় থাকা যুবক জানিয়েছেন, বিদেশ আগ্রহী যুবকদের জিম্মি করে তাদের স্বজনদের কাছে অডিও ও ভিডিও কল দিয়ে টাকা লুটে নিতো মাফিয়া। আমার ছোট ভাইকে ফোনকল দিয়ে ১১ লাখ টাকা দাবী করে। দাবীকৃত টাকা না দিলে আমাকে হত্যা করা হবে। আমাকে বাঁচাতে ১১ লাখ টাকা দেন আমার পরিবারের লোকজন। সেখানে ৭ মাস থাকার পর আরেক মাফিয়ার কাজে বিক্রি করে দেওয়া হয়। ওইখানে তিন মাস আটকে রাখে। পরে ওইচক্রকে ৩ লাখ দিয়েও ছাড়া পাইনি। একদিন গেম এর কথা বলে বন্দিদের একটি মাইক্রোতে উঠানো হচ্ছিল। আমাকেও নেয়া হবে। আমাদেরকে যে ভবনে আটকে রাখা হয়েছিল, হঠাৎ দেখলাম ছাদে লোকজন কেউ নেই। এসুযোগে কৌশলে আমরা তিনজন ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচের একটি বাগানে পড়ে দৌড়ে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকি। সারারাত জঙ্গলে অনাহারে থাকারপর ফজরের নামাজের সময় একটি মসজিদে আশ্রয় নিই। পরে মসজিদের ইমামদের সহযোহিতায় দেশে ফিরেছি।
শারিরীক ও মানসিক নির্যাতনে এখনও চিকিৎসা নিচ্ছি।
এবিষয়ে গত ৫ ডিসেম্বর জগন্নাথথপুর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। অভিযোগপত্রে ১৪ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। অভিযুক্তরা হলেন, জগন্নাথপুর উপজেলার কলকলিয়া ইউনিয়নের পাড়ারগাঁও গ্রামের সাকিবুর রহমান ছেলে সোহাগ মিয়া,তার মা ছুলফা বেগম,কাতিয়া গ্রামের লেপাছ মিয়ার স্ত্রী লাভলী বেগম, আলাগদি গ্রামের মৃত মুজেফর আলীর ছেলে মুজিবুর রহমান,সাজিদুর রহমান,বালিকান্দি গ্রামের মৃত গিয়াস উদ্দিনের ছেলে রাসেল মিয়া, আসামপুর গ্রামের মৃত আশিক মিয়ার ছেলে এনাম মিয়া, ওই গ্রামের আশরাফ মিয়া, আফরোজ মিয়া,ইকড়ছই গ্রামের আপ্তাব আলী, মেয়ে পপি বেগম,ছেলে রুবেল মিয়া,কামারখাল গ্রামের হবিব মিয়ার ছেলে রুবেল মিয়া ও একই গ্রামের ছালিক মিয়ার ছেলে টিপু মিয়া।
মামুনুর রহমানের ছোট ভাই হিমেল জানায়, ইতালি না পাঠিয়ে একাধিক বার মাফিয়া চক্রের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয় আমার ভাইকে। তাঁকে বাঁচাতে ৪৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় মাফিয়া ও মানব পাচারকারী চক্র। তিনি জানান, ধারকর্জ আর বাড়ি বন্ধক রেখে এসব টাকা যোগার করতে হয়েছে।
এবিষয়ে জানতে অভিযুক্ত কয়েকজনের সঙ্গের মুঠোফোনে যোগোযোগের চেষ্টা করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি । তবে ছুলফা বেগম জানান, এবিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।
জগন্নাথপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মিজানুর রহমান জানান, অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টির তদন্ত চলছে।

Facebook Comments Box

Posted ১২:৩৯ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩

ajkersangbad24.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

সম্পাদক
ফয়জুল আহমদ
যোগাযোগ

01712000420

fayzul.ahmed@gmail.com