মো. জহিরুল ইসলাম | শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | প্রিন্ট | 81 বার পঠিত
বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা হবে। চলছে আত্মীয়-স্বজনদের নানা জল্পনা-কল্পনা। আলোচনা ছড়িয়ে পড়ছে ঘর থেকে পাড়ায়, পাড়া থেকে গ্রামে। পাত্রের যোগ্যতা কি? মেট্রিক পাশ? কোরআন পড়েছে? নামাজ কালাম পড়ে? পাত্রীর নানার বাড়ির তথ্য নেয়া। মনে করা হতো মা গুণে জ্বী। আবার এক পক্ষ লেগে যেতো (কাটনি করতে) বদনাম রটাতে। এজন্যই প্রবাদে আছে “সৎ কাজে শতেক বাঁধা “। ভাল কাজে দেরি করতে নাই।
মুরুব্বিরা বসবেন আলোচনায়। অল্প বয়সীদের এ আলোচনায় থাকতে মানা। দর-দাম হাঁকাবেন। চুল ছেঁড়া বিশ্লেষণ হবে। আলোচনার মূখ্য বিষয় মোহরানা। তারপর বেবার (বর ও কনের পক্ষ থেকে কয়টা শাড়ি, কয়টা লুঙ্গি, গয়নাগাটি কি কি ইত্যাদি)। বর পক্ষের কোন এক দুলাভাই দাঁড়িয়ে বলে উঠবেন একটা সাদাকালো টেলিভিশন আর একটা ফনিক্স সাইকেল। খাট, ল্যাপ-তোশক তো লাগবেই। এভাবেই চলতে থাকে দেন-দরবার। তারপর সিদ্ধান্ত।
পাত্র পাত্রীর সরাসরি কোন দেখা সাক্ষাৎ নাই। এটিকে নিন্দনীয় ভাবা হয়। পছন্দ করার জন্য ভাবী বা ছোট ভাই-বোনকে বাছাই করা হবে অথবা দাদা-দাদীকে। তারা কনের হাতের আঙুল, পায়ের আঙুল দেখবে, মাথার চুলের গিট খুলে দেখবে, তাদের সামনে একটু হাটাবে। কালেমা জিজ্ঞেস করবে, জিজ্ঞেস করবে নামাজ-রোজা সম্পর্কে ইত্যাদি। তারা গিয়ে বাড়িতে রিপোর্ট পেশ করবে।
এদিকে, এক দুই দিন আগে থেকেই বোনদের স্বামীসহ আগমণ ঘটে। নিজের বোন ভাগ্নীসহ, চাচাতো, ফুফাতো ও নিকট আত্মীয়দের। রাতভর দিনভর চলে রং-ঢং, হই হুল্লোড়, আনন্দের ঘনঘটা। চাঁদনী রাত হলে তো কথাই নেই। উঠানে শীতল পাটি, সাথে ছালার চট ( পাটের বস্তা) বিছিয়ে মেতে উঠে আড্ডায়। সিল্লুক (ধাঁধা), সীমাসা (প্রচলিত প্রবাদ), গল্প আর আঞ্চলিক গীতে যেন মুগ্ধ হয়ে উঠে চারপাশ। সারা পাড়াজোড়ে গুঞ্জন। এ আয়োজন গুলো সাধারণত বর্ষায় হয়। এ সময়ে গ্রামের কানায় কানায় পূর্ণ থাকে পানি। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে নৌকায় সহজ যাতায়াত। তাছাড়া বৈশাখী দাওয়া-মারা ( ধান তোলা) শেষে সবাই বেকার থাকে। এ সময়টাই বেশ উপযোগী। তাই বিয়ের আয়োজনের উত্তম সময় এটিই।
দিন তারিখ ধার্য হলো। দূর-দূরান্তের আত্মীয়দের দাওয়াত দেয়ার পালা। কোন এক দুলভাই অভিমান নিয়ে বসে আছেন তাকে উপযুক্ত সম্মান দিয়ে দাওয়াত করা হয় নাই। এবার তাকে মান ভাঙাতে হবে। মুরুব্বিদের দোহাই পর্যন্ত পৌছাবেন, তবেই তো মান ভাঙবে তাঁর।
বর-কনের জন্য পোশাক-আশাক কেনার পালা। দুই পক্ষের কে কে বাজারে যাবে তা ঠিক করা খুবই কঠিন কাজ। আবার কে যেন অভিমানী হয়ে উঠবে! ছোট চাচা বা কোন এক দুলাভাই। তার মান না ভাঙ্গালে বিয়ে ভাঙারও সম্ভাবনা থাকে। যা হোক, বাজারে গিয়েও চলে দুই পক্ষের দর-কষাকষি। কখনও মান অভিমান। অবশেষে, সুন্দর লাগেজে সাজানো হয় বর-কনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। এখানেও রিস্ক আছে, অঞ্চলভেদে নানা চল ( নিয়ম) আছে। কোন একটার কমতি পড়লে মহিলাদের মধ্যে শুরু হবে তুমুল বাকযুদ্ধ। নিজের ভাবীরা কখনো ছাড় দিলেও পাড়ার ভাবীরা এতে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে নারাজ। এ যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত গড়াতে পারে দাম্পত্য জীবনে।
এদিকে বিয়ের দুইদিন আগেই ভ্যানপার্টি এসে হাজির ঢাক-ঢোল আর সানাই বাজিয়ে। সারা পাড়ার মধ্যে দুই একটা আলগঘর ( বাংলো) থাকতো। সামনে বড় উঠান। গ্রামের লোকজন এসে ভীড় জমাতো ভ্যানপাটিকে ঘিরে। সারারাত বাজানো হতো মাইক। আসতো লাটি খেলোয়াড়। সবচেয়ে আনন্দদায়ক খেলা। ভ্যান বাজিয়ে ছন্দের তালে তালে নাচতো তারা। সাথে ছিল একটা রূপক ঘোড়া।একজন বিশাল আকৃতির ঘোড়ার মাঝখানে ঢুকে নাচ দেখাতো। খেলার শেষের অংশটাই বেশ আকর্ষণীয়। দেখানো হতো জাদুর খেলা। কলসি ভর্তি পানি মাথায় নিয়ে নাচ দেখাতো, হাতে ছিল একটি থালা। মা-চাচীরা এসে বকশিস দিতো। কখনো বালি দিয়ে বিস্কুট বানিয়ে খাওয়াতো, কখনো জ্যান্ত মানুষকে ছুরি মেরে অজ্ঞান করে ফেলতো। মানুষকে বোকা বানানোরও নানা প্রকার আইটেম ছিলো তাদের হাতে। এগুলো ছিলো একটি অভিজাত বিয়ের আয়োজন। আনন্দ আর আনন্দ। সারা গ্রামের সব মানুষের মধ্যেই আনন্দের বন্যা বয়ে যেতো। বিয়েটা মনে হতো সারা গ্রামবাসীর। কেউ এই আনন্দের বাইরে নয়।
নয়া দামানের গোসল। ভাবীরা মিলে গোসল করাবে। এর আগে নতুন লুঙ্গি পড়িয়ে গায়ে হলুদ মাখিয়ে প্রস্তুত করা হবে তাকে। চলবে মহিলাদের দলবেঁধে বিয়ের গীত। সালা-দুলাভাইদের চলবে কাঁদা মাখা-মাখী আর কুস্তি খেলা। কাউকে ঘর থেকে বের করা হবে টেনেহিঁচড়ে। গোসল করানো শেষ না হওয়া পর্যন্ত চলবে নানা রং-ঢং।
নৌকা প্রস্তুত করা হবে। কলাগাছের খুঁটি দিয়ে তৈরি হবে গেইট। গেইট তৈরিতে কাজে লাগবে বাজার থেকে নিয়ে আসা কালার কাগজ, বেলুন ইত্যাদি । যুবক ছেলেরা এই নিয়েই ভীষণ ব্যস্ত। পাড়ায় কয়েকজন এক্সপার্ট থাকে গেইট সাজাতে। স্বেচ্ছা শ্রমেই এ কাজে অংশ নেয় তারা।
বিয়ে হবে রাতে। সন্ধ্যায় বর যাত্রী পৌঁছাবে কনের ঘাটে। নৌকা পারে ভীরবে এমন সময় শুরু হবে ঢিল ছুড়া। এ যেন কমন ঘটনা। মাঝে মধ্যে বিচ্ছিন্ন ঘটনাও ঘটে যায় কোথাও। মুরুব্বিরা এসে সমাধান করতে হয়। বরের আসন সাজানো আছে। ঘাট থেকে শুরু করে আলগঘর ও অন্দরমহল পর্যন্ত গেইট আর গেইট। প্রথম গেইটে কনের পক্ষের শরবত ও পান পরিবেশন। গেইটে বড় করে লিখা থাকবে শুভেচ্ছা মূল্য পাঁচশত এক টাকা। সালা-সালীরা নিয়ে আসবে গলার মালা। চলবে উভয় পক্ষের ধাঁধা আর সিল্লুকের বাকযুদ্ধ। কেউ কাউকে ছাড় দিবে না। অবশেষে অসমাপ্ত রেখেই মুরব্বিদের একপ্রকার ঝারি খেয়ে শেষ হবে প্রথম পর্ব। এভাবে ধাপে ধাপে বর ও তার সহপাঠীদের কঠিন মুহূর্ত অতিক্রম করতে হবে।
রাতে বেড়ার ফাঁক দিয়ে ছুড়বে রঙ। এমন কেউ বাদ যাবে না যার জামা-কাপড় রঙিন হবে না। দুই পক্ষের মেহমানদের গল্প-স্বল্পে কাটবে রাত। চলবে বিয়ের প্রস্তুতি। বর-কনের কবুল বলার পালা। অনেক সময় ধরে স্বাক্ষী নিয়ে দাঁড়িয়ে কাজী সাব। কবুল তো আর শুনা যাচ্ছে না। ভাবীরা এসে শিখিয়ে দিচ্ছে, বারবার কানে কানে ফিসফিস করছে, তবুও যেন কাজ হচ্ছে না কিছুতেই। গ্রামের মেয়ে। লাজুকতা ভাঙা যেন এক কঠিন যুদ্ধ। নিজের স্বত্ব অর্পণ। তাও আবার অজানা-অচেনা কোন এক বরপুত্রের হাতে। অবশেষে আবছা শুনা গেলো কবুলের শব্দ।
একালের বিয়ে।
দুইভাবে হয়ে থাকে। হয় ছেলেমেয়েরা আগেই নিজেরাই নিজেদের পছন্দের পাত্রপাত্রী খুঁজে নিবে অথবা, পারিবারিক ভাবে ঠিক করা হবে। তবে পারিবারিক ভাবে ঠিক করা হলেও আগে পাত্র-পাত্রীর দেখাশোনা বা বুঝা পরামর্শই মূখ্য। যা হোক, আমার উদ্দেশ্য হলো সম্পর্কের পরিধিটা কতটুকু প্রসারিত হচ্ছে তার একটা অনুকল্প তৈরি করা।
বিয়ের প্রাথমিক আলোচনা। পরিবারের সদস্যরাই পরস্পরের সাথে মতবিনিময় করবে। বড় জোড় খুব ঘনিষ্ঠ দু’একজন প্রতিবেশীকে রাখা হবে। উভয় পক্ষের সম্মতি হলেই দিন তারিখ ধার্য করা হবে। স্থান কোন একটি কমিউনিটি সেন্টার। বিয়ের কার্ড ছাপানো হবে নির্দিষ্ট সংখ্যক। দাওয়াতি সংখ্যার উপর নির্ভর করেই সব আয়োজন হবে সেন্টারে। বর-কনে সাজানো হবে বিউটি পার্লার থেকে।সেন্টারের দুইপাশে বসানো হবে বরের আসনে বর আর কনের আসনে কনে। দাওয়াতি মেহমানরা সাজ-গুজ করে আসবে যে যার মতো করে। টেবিলে সাজানো থাকবে খাবার। দাওয়াতিদের টার্গেট হলো খাবার টেবিলে স্থান করে নেওয়া। এক পর্ব শুরু হলে অন্য পর্বের জন্য অপেক্ষা। এর ফাঁকে কেউ কেউ গিয়ে বর বা কনের সাথে একটা সেলফি নিয়ে আসবে। আবার কেউ বিড়ম্বনা মনে করে স্টেজ পর্যন্ত না গিয়েও শুধু খাওয়ার সুযোগটা নিয়েই চলে আসবে। ফলে নব দম্পতির সাথে কোন ভাবের আদান প্রদান ঘটে না। পারিবারিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়না। কখনওবা ভুলেই যায় এই দাম্পত্যের স্বাক্ষী ছিল তারা। পরবর্তী সময়ে ঐ দম্পতির ছেলেমেয়েদের কেউ চিনে না। ওদের আপনজন শুধুই দাদা-দাদিসহ পরিবারের সদস্যরাই। এভাবেই বড় হতে থাকে একটা ক্ষুদ্র পরিসরে। বর-কনের এই শর্ট-কাট সম্পর্ক জীবনের গন্ডিকেও শর্টকাট করে ফেলে। সম্পর্কের এই ক্ষুদ্র পরিধি জীবনে চলার পথে নানা প্রতিকূলতা সৃষ্টি করে। মানুষ মাত্রই সামাজিক জীব। সামাজিক সম্পর্ক ও পরিচিতি যার যত বেশি তার জীবন তত সুন্দর। জীবন কখনও হতাশায় নিমজ্জিত হয় না। কারণ প্রতিটি স্তরেই সাহায্যের লোক পাওয়া যায়। কঠিন বিপদ সহজ হয়ে উঠে। আবার ক্ষুদ্র পরিধির দাম্পত্য জীবন নানা প্রতিকূলতায় হাঁফিয়ে উঠে। অনেক সময় নিজেদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। সম্পর্কে ফাটল ধরে। কখনও শুরু হয় বিচ্ছেদ। সামাজিক দায়বদ্ধতাও কম থাকে। কারণ খুব কম সংখ্যক মানুষের সাথে তাদের পরিচয়, উঠা-বসা। ফলে এই সম্পর্কগুলো গভীর হয় না। ছেলেমেয়েরা একাকিত্ব বোধ করে। সমাজের মানুষের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে পারে না। সমাজের প্রতি আবেগ সৃষ্টি হয় না। ফলে তাদের মনে অনেকটাই যান্ত্রিকতা ভীড় করে। দেশাত্মবোধ সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে কম। সুতরাং বিয়ে শুধু একটি সম্পর্কই তৈরি করে না বরং সমাজ গঠনেও এর ভূমিকা অপরিসীম।
[ লেখক : প্রভাষক অর্থনীতি বিভাগ, শাহজালাল কলেজ ও সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (বাকবিশিস) জগন্নাথপুর উপজেলা, সুনামগঞ্জ]
Posted ৯:১০ অপরাহ্ণ | শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
ajkersangbad24.com | Fayzul Ahmed