মঙ্গলবার ২২শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম >>
শিরোনাম >>

দুর্দিন থেকে সুদিনে ফেরা

ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)   |   শনিবার, ১৮ মে ২০২৪   |   প্রিন্ট   |   61 বার পঠিত

দুর্দিন থেকে সুদিনে ফেরা

একাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশের যে স্মৃতিটি সেই সময়কার শিশু আজকের আমার স্মৃতিতে খুব অদ্ভুতভাবে হলেও খুবই উজ্জ্বল তা হলো- রেশনশপে গিয়ে চটের বস্তায় রেশন নিয়ে বাসায় ফেরা। আমার বাবা সে সময়ে ছিলেন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের একজন তরুণ নির্বাহী প্রকৌশলী। সরকারিভাবেই থাকার জন্য তার কপালে বরাদ্দ হয়েছিল পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া গুলশানের একটি সরকারি বাসা।

সে সময় সরকারিভাবে রেশন দেওয়া হতো আর সব পরিবারের জন্য বরাদ্দ ছিল একটি করে রেশন কার্ড। সেদিনের বাংলাদেশে সরকারি আমলাতন্ত্রের পরিধিটা ছিল খুবই ছোট। নির্বাহী প্রকৌশলীই সে জমানায় ছিলেন অনেক বড় সরকারি কর্মকর্তা। তবে বড় হন আর ছোট হন, হন কর্মকর্তা কিংবা কমর্চারী, হতে পারেন খুবই সাধারণ অথবা অসাধারণ, যাই হন আর নাই হন না কেন, সেদিনের বাংলাদেশে সবার জন্য ওই হলুদ রেশন কার্ডটি ছিল দারুণ কাজের একটা জিনিস।

রেশনের দোকান থেকে রেশনের চাল বাসায় নিয়ে আসার পর রান্নাঘরের সামনে সেই চাল মেঝেতে বিছিয়ে তা থেকে নুড়ি পাথর বাছাই করা ছিল আরেক চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি এক ধরনের উৎসবও। তারপরও ভাতের লোকমায়, অত যাচাই-বাছাইয়ের ফাঁক গলে যে নুড়িগুলো মুখের ভেতর চালান হতো, তাতে কামড় পড়লে খবর হতো ‘কত নুড়িতে কত চাল’।

সদ্যই টিভির পর্দায় এসএসসি পাস ছেলে-মেয়েদের বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস দেখতে দেখতে নিজের এসএসসির কথা মনে পড়ছিল। আমার এসএসসি ১৯৮৫ সালে। বাবা তখন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী। পদটি এখনো বড় আর তখন ছিল আরও অনেক বড়। অল্প কিছু মহাসড়কের সেদিনের বাংলাদেশের এই অধিদপ্তরে এই পদমর্যাদার কর্মকর্তার সংখ্যা তখন এক হাতের পাঁচ আঙ্গুলে গুনেই শেষ করা যেত।

বাবার জন্য তখন সরকারিভাবে বরাদ্দ ছিল এয়ারপোর্ট রোডের ওপর অধিদপ্তরটির একটি সরকারি বাসা। হালে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একটি র‌্যাম্প তৈরি করতে গিয়ে বাসাটা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। তবে ওই বাসায় থেকে সরকারি গাড়িতে চেপে এসএসসি পরীক্ষার হলে যাওয়ার সৌভাগ্যটা আমার ভাগ্যে জোটেনি। বাসাটা তখনো ছিল, তবে আমাদের রাতারাতি বাসাটা থেকে এক ধরনের বেরই করে দেওয়া হয়েছিল।

কারণ সেই সময়ের মহাপরাক্রমশালী প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল হো. মো. এরশাদ কোনো কারণ না দেখিয়েই কলমের এক খোঁচায় বাবার চাকরিটা খেয়ে দিয়েছিলেন। ‘তার দৃষ্টিতে’ সিলেট অঞ্চলের বাসিন্দা আমার বাবার সঙ্গে সিলেটের আব্দুস সামাদ আজাদ, দেওয়ান ফরিদ গাজী, সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত টাইপের ‘ভারতীয় দালাল রাজনৈতিক নেতাদের’ বাড়াবাড়ি, মাখামাখি আর আওয়ামী লীগ নামক ‘দেশবিরোধী’ রাজনৈতিক দলটির প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যের কারণে।
এসএসসি পাস করে ভর্তি হয়েছিলাম ঢাকা কলেজে। সরকারি বিলাসবহুল বাসা ছেড়ে উঠেছিলাম কাছেই দুই রুমের একটা বাসায়। সেখানে আবার এসে জুটেছিলেন আমার বড় মামা। আলজিরিয়ার আমাদের রাষ্ট্রদূত ছিলেন তিনি। তাকেও একই ধরনের অপরাধে কলমের আরেক খোঁচায় বেকার বানিয়ে, ঢাকায় এনে দুই রুমের ওই বাসায় আমাদের সঙ্গে এসে থাকার বন্দোবস্তটা পাকাপোক্ত করেছিলেন জেনারেল এরশাদ।

মনে আছে, সে সময় চেয়ারম্যানবাড়ি থেকে আনন্দ সিনেমা হল পর্যন্ত টেম্পু ভাড়া ছিল সম্ভবত এক টাকা। আর সঙ্গে আরও পঞ্চাশ পয়সা যোগ করে ছন্দ সিনেমা হলের সামনে থেকে অন্য টেম্পুতে যাওয়া যেত সোজা ঢাকা কলেজ অবধি। অধুনালুপ্ত সেই টেম্পুগুলো ছিল ঢাকার দারুণ এক রেজিস্টার্ড ট্রেডমার্ক পাবলিক ট্রান্সপোর্ট।

দৈর্ঘ্যে আজকের সিএনজিগুলোর চেয়ে বড়জোর একফুট লম্বা আর চওড়ায় ইঞ্চি ছয়েক কম। তাতে দুপাশের বেঞ্চে পাঁচ-পাঁচ দশজন মানুষ একে অপরের দু’পায়ের চিপায় নিজেদের একটি করে পা সেট করে দারুণ আনন্দে চড়ে বেড়াতেন। সঙ্গে বাড়তি পাওনা ছিল টেম্পুর আগ্নেয়গিরিতুল্য অবিরাম ঘন, কালো আধপোড়া মবিল মিশ্রিত ধোঁয়া উদগীরণ আর ক্রমাগত ভটভট শব্দের দারুণ সিম্ফনি।

ঢাকা কলেজ থেকে পাস করে ভর্তি হলাম ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে। সেই জমানায় আমাদের ব্যাচের বেশিরভাগ ছেলেরই হোস্টেল বাসের মেয়াদ ছিল মাসখানেকের। আর পরের ব্যাচগুলো তো বলতে গেলে হোস্টেলের মোটা চাল আর পানি মিশ্রিত ডাল উপভোগ করার সুযোগই পায়নি। কারণটা খুব সরল।

একানব্বইয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণের পর ছাত্রদলের বন্ধুরা দেশের অন্যান্য ক্যাম্পাসের মতো ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের বাঘমারার বয়েজ হোস্টেলের রুমগুলোকে তাদের পৈত্রিক উত্তরাধিকার ধরে নিয়ে বাদবাকি সবাইকে পাকাপাকিভাবে হোস্টেল ছাড়া করে ছেড়েছিল।

আমাদের হোস্টেলের স্মৃতি হচ্ছে চরপাড়ার পাশাপাশি বেশ কটি বাড়িতে একেকটা ফ্ল্যাটে গাদাগাদি করে অনেকের হোস্টেল বানিয়ে থাকা। আর বিকেলে ওই চরপাড়ারই ইদানীংকালে ভরাট করে ফেলা পুকুরটার ধারে, এখন বিলুপ্ত লিটনের চায়ের টংটাকে হোস্টেল ক্যান্টিন বানিয়ে সান্ধ্যকালীন আড্ডায় মশগুল হওয়া।
আজকের বাংলাদেশ এগিয়েছে না পিছিয়েছে অতশত হিসাবে আমি যাই না। যাই না কারণ ওই হিসাব কষার আদৌ কোনো প্রয়োজনীয়তাই আমার কাছে প্রয়োজনীয় বলে মনে হয় না। ‘গণতন্ত্র, গণতন্ত্র’ বলে যেসব নেতা গলাবাজি করেন, তাদের ভাষা কেন যেন বুঝি না।

শুধু বুঝি আমাদের সন্তান সূর্য-সুকন্যা যদি ভবিষ্যতে আমার মতো কলম ধরার চেষ্টা করে আর লিখেও ফেলে দুই একটি কলাম, তবে তাদের এমনি কোনো স্মৃতিচারণ হবে মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট আর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের পাশাপাশি ক্যাফে নেটফ্লিক্স, স্টার্টআপ ইত্যাদি গল্পে ঠাসা।

আমাদের বাবা-মাদের মুখে আমরা শুনেছি রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধের গল্প আর কায়কোবাদের মহাশ্মশানকে গোরস্তান বানানোর কেচ্ছা। ওরা জানবে যদি কোনো দুরাচার বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে বুড়িগঙ্গায় ছুড়তে চায়, তবে তার ঠাঁই হয় কারাগারে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি এখন অতীতের স্মৃতি। এখন সাকা আর গো আজমদেরও পাপের দণ্ড পেতে হয় আর ম্যাডামকে যেতে হয় চার দেওয়ালের পেছনে।

সেদিনের বাংলাদেশটাকে এই দিনে নিয়ে আসার জন্য সবটাই যার কৃতিত্ব, সেই মহিয়সী নারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৮১-এর এই দিনে মৃত্যুকে তুচ্ছজ্ঞান করে, পরিবারের অবশিষ্টাংশকে ফেলে রেখে তিনি দেশে ফিরে এসেছিলেন বলেই আজকের বাংলাদেশ এত সুন্দর।

লেখক : অধ্যাপক, ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও
সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।

Facebook Comments Box

Posted ১০:২০ অপরাহ্ণ | শনিবার, ১৮ মে ২০২৪

ajkersangbad24.com |

এ বিভাগের আরও খবর

সম্পাদক
ফয়জুল আহমদ
যোগাযোগ

01712000420

fayzul.ahmed@gmail.com