মঙ্গলবার ২১শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম >>
শিরোনাম >>

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির এক কিংবদন্তি পুরুষ

মুক্তাদীর আহমদ মুক্তা   |   শনিবার, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪   |   প্রিন্ট   |   69 বার পঠিত

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির এক কিংবদন্তি পুরুষ

স্বাধীকার, স্বাধীনতা সংগ্রামসহ বাংলাদেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাঁর ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ। বাংলাদেশের উন্মেষ ও বিকাশে গণমানুষের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি সবসময় ছিলেন সামনের কাতারে। ভাটিবাংলার অবিসংবাদিত এই নেতা ছিলেন সাংবিধানিক, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল রাজনীতির এক নির্ভীক কন্ঠ।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বভাবসুলভ রসবোধ আর যুক্তিপূর্ণ বাগ্মিতায় তিনি পৌঁছেছিলেন অনন্য উচ্চতায়। তিনি ছিলেন সাচ্চা দেশপ্রেমিক, সত্যিকারের গণ মানুষের নেতা। সাধারণ মানুষের মনের ভাষা তিনি পড়তে পারতেন। মানুষকে উজ্জীবিত করাই ছিল যেন তাঁর প্রশান্তি। রাজনৈতিক সকল সংকটে তিনি নিজ এলাকার মানুষের কাছে ছুটে যেতেন। মানুষের সমর্থন নিয়ে প্রথাবিরোধী হুংকার দিতেন আপন মহিমায়।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ সমরের যোদ্ধা এবং সংগঠক সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন বাংলাদেশের সংবিধান প্রনয়ণ কমিটির সদস্য। সাত বারের জাতীয় সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী, আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেন বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন ও বিকাশে ছিলেন সোচ্চার কন্ঠ। দল ও দলের বাইরে নানাবিধ আক্রমণ ও দহন সহ্য করে কখনো কখনো আপোষ করলেও নিজস্বতা ও স্বকীয়তা বিসর্জন দেননি।

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন একজন বাস্তববাদী দূরদর্শী রাজনীতিবিদ। বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় তিনি নিস্কলুষ ছিলেন না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েলে তাঁর কৌশলী উচ্চারণগুলোতে থাকতো শিল্পবোধ। তিনি সুস্থ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিশ্বাস করতেন। ষড়যন্ত্র ও প্রতিহিংসা ছিল তাঁর চরিত্র বিরুদ্ধ। সংবিধান বিশেষজ্ঞ এই নন্দিত পার্লামেন্টারিয়ানের সাহিত্য,সংস্কৃতির প্রতি ছিল গভীর অনুরাগ। বক্তব্য,বিবৃতিতে তিনি প্রায়শই কবিতার পংক্তি ব্যবহার করতেন। সাধারণ মানুষের ভাষা রপ্ত করা, সাহিত্যের রসবোধ আর প্রখর মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন জননেতা ছিলেন তিনি। তেজ ও নাটকীয়তায় ভরা বক্তব্যে তিনি সংসদ থেকে জনসভা সর্বত্র মুগ্ধতা ছড়াতেন। রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন সময় নানা প্রতিকূলতা আর উল্টোস্রোতে সাঁতার কেটে হয়ে উঠেছিলেন একজন সংগ্রামী। স্বভাবসুলভ বিপ্লবী। অমিত সাহস নিয়ে কথা বলতেন যুক্তিপূর্ণ মুক্তচিন্তায়। হাস্যরসাত্বকভাবে সহজ ভাষায় কঠিন আক্রমন করতেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে।

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন আজীবন রাজনীতির মাঠে আলো ছড়ানো তারকা। মাটি আর মানুষের কাছে থেকে রাজনীতি করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন গ্রহনযোগ্য এবং কর্মী বান্ধব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। হাওরের কঠিন-কোমল প্রকৃতিতে বেড়ে ওঠা একজন সুরঞ্জিত বর্ণিল রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় হয়ে উঠেছিলেন সংসদীয় রাজনীতির কবি। নিজস্ব ভাষা, ভঙ্গি আর স্বভাবসুলভ উচ্চারণে তিনি ছিলেন কিংবদন্তি জননেতা । জাতীয় সংসদে,সংবাদ সম্মেলনে, রাজনৈতিক জনসভায় তিনি কথা বললে জনতা হাসতেন, কাঁদতেন, জাগতেন। সজ্জন, সদালাপী ব্যক্তি সুরঞ্জিত ছিলেন সব দলমতের মানুষের কাছে সমান প্রিয়। আর ভাটি বাংলার মানুষের কাছে ছিলেন আশা আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক। বরেন্য রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের প্রয়োজনীয়তা যতদিন যাচ্ছে তত যেন আরো বাড়ছে। জাতীয় সংসদে তাঁর অনুপস্থিতি দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করেছে।

ষাটের দশকে ছাত্র ইউনিয়নের একজন নেতা হিসেবে ছাত্র রাজনীতিতে রেখেছেন অসামান্য অবদান। ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনেই চমক সৃষ্টি করেছিলেন। বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)’র হয়ে নির্বাচন করে জয়ী হন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটিরও সদস্য ছিলেন। এরপর ধীরে ধীরে কেবলই এগিয়ে চলা। আটবার নির্বাচনে জয়ের রেকর্ড তাঁর ঝুলিতে। সংসদে ঝড় তুলেছেন বারবার। সংসদীয় রাজনীতির এক অমর কবি তিনি।

অন্যসব পরিচয় ছাপিয়ে তিনি খ্যাতি পেয়েছেন এক অভিজ্ঞ পার্লামেন্টেরিয়ান হিসেবেই। বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাস যতদিন থাকবে ততদিন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নাম উচ্চারিত হবেই।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভাটি বাংলায় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ৫ নম্বর সেক্টরের, টেকেরঘাট সাব-সেক্টর গঠনে তিনি অসামান্য অবদান রাখেন এবং শুরুর দিকে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি অংশ গ্রহণ করা স্মরণীয় এই রাজনীতিকের অন্যতম পরিচয় হচ্ছে, তিনি একজন সংবিধান এবং আইন বিশেষজ্ঞ।

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরপর আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে। অভিজ্ঞ এই রাজনীতিবিদ মানুষের মাঝে বেশি পরিচিত ছিলেন সংসদে তাঁর যৌক্তিক, চাতুর্যপূর্ণ এবং রসাত্মক বক্তব্যের জন্য। রাজনীতিবিদ হিসেবে বিপক্ষের নেতাদেরও সমীহ পেয়েছেন তিনি।

সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার আনোয়ারপুর গ্রামে জন্ম নেয়া সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ও পরে ঢাকা সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে আইনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

সত্তরের নির্বাচনের পর স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭৯ সালে একতা পার্টি থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। সামরিক স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে করেছেন কারাবরণ। ১৯৮৬ সালে আবারও নির্বাচনে জয়লাভ করেন। ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গণতন্ত্রী পার্টি থেকে নির্বাচন করে সংসদে যান। পরে গণতন্ত্রী পার্টি ত্যাগ করে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সুনামগঞ্জ ২ আসন থেকে সামান্য ভোটে হেরে গেলেও পরে হবিগঞ্জের একটি আসনে উপ-নির্বাচনে বিজয়ী হন। এরপর ২০০১ সালে সুনামগঞ্জ-২ আসন থেকে আবারও বিজয়ী হন। ২০০৮ ও ২০১৪ সালে সংসদ নির্বাচনেও তিনি জয়লাভ করেন।

পঞ্চম সংসদের সদস্য থাকাকালেই আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে প্রথমে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং পরে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্য।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোটের বিশাল বিজয়ের পর সুরঞ্জিতকে আইন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পান। পরে ২০১১ সালের ২৮ নভেম্বর রেলমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন সুরঞ্জিত। কিন্তু ব্যক্তিগত সহকারীর দুর্নীতির দায় মাথায় নিয়ে পরের বছর (২০১২) ১৬ এপ্রিল মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে দফতরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রীসভায় রেখেছিলেন।

এ সময় নির্দোষ প্রমাণিত না হলে সক্রিয় রাজনীতি করবেন না বলে সুরঞ্জিত ঘোষণা দেন। এপিএস’র অর্থ কেলেঙ্কারীর ঘটনা তদন্ত করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সুরঞ্জিত সেনকে নির্দোষ ঘোষণা করলে আবারও রাজনীতিতে সক্রিয় হন তিনি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলে তিনি আবারও আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করে গেছেন।

২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট, নারকীয় গ্রেনেড হামলার মুহূর্তে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে ঘিরে যে মানববর্ম গড়ে তুলেছিলেন উপস্থিত নেতৃবৃন্দ, তিনি তাঁদের অন্যতম। সেদিনের হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেডের স্প্লিন্টার মৃত্যু পর্যন্ত বহন করেছিলেন।

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এক বিরলপ্রজ ব্যক্তি। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনের পর তিনি প্রধানমন্ত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। তিনিই বাংলাদেশের এমন পদবিধারী প্রথম ব্যক্তি। মন্ত্রীর মর্যাদায় তাঁর জন্য এই পদ সৃষ্টি করা হয়। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে রেল মন্ত্রণালয় পৃথক করে তাঁকে দেশের প্রথম রেলমন্ত্রী করা হয়। এপিএসের অর্থ কেলেংকারীতে প্রশ্ন ওঠায় তিনি দায় মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করেন। বাংলাদেশে মন্ত্রীর পদত্যাগের ঘটনাও এই প্রথম। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে তাঁকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে বহাল রাখেন। তিনিই দেশের প্রথম দপ্তরবিহীন মন্ত্রী।

মন্ত্রী বা মন্ত্রীর পদ মর্যাদায় দায়িত্ব পালন করলেও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সরকারি বাড়ির সুবিধা নেননি। সাত বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েও এমপিদের জন্য সংরক্ষিত প্লট গ্রহণ করেননি। নীতি নিষ্ঠ এই রাজনীতিবিদের ধ্যান-জ্ঞান ছিল সংসদীয় রাজনীতির বিকাশ ও কার্যকর জাতীয় সংসদ।

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ।

Facebook Comments Box

Posted ৮:৫৮ অপরাহ্ণ | শনিবার, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

ajkersangbad24.com |

এ বিভাগের আরও খবর

সম্পাদক
ফয়জুল আহমদ
যোগাযোগ

01712000420

fayzul.ahmed@gmail.com