বুধবার ১৯শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৫ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম >>
শিরোনাম >>

১৯ মার্চ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে গাজীপুরবাসীর কৃতিত্ব চির অম্লান

গাজীপুর প্রতিনিধি   |   মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫   |   প্রিন্ট   |   35 বার পঠিত

১৯ মার্চ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে গাজীপুরবাসীর কৃতিত্ব চির অম্লান

” ডান হাতে তাজা গ্রেনেড আমার, বাম হাতে রাইফেল। বিদ্রোহী আমি মুক্তিপিয়াসী, প্রাণ সদা উদ্বেল। আমি তোমাদের চেনা, আমি যে মুক্তিসেনা ” । রাজধানী ঢাকার অদূরে গাজীপুর জেলার ঐতিহ্যবাহী চৌরাস্তায় মুক্তিযোদ্ধাদের স্মারক ভাস্কর্য-জাগ্রত চৌরঙ্গী, সেই দীর্ঘ অর্ধশত বছর পূর্বের স্বাধীনতা সংগ্রামের অজানা ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশে সর্বপ্রথম ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ গাজীপুরের জয়দেবপুরে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার মধ্যে শত স্মৃতি ও হৃদয়স্পর্শী ঘটনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। দেশব্যাপী স্বতঃস্ফূর্ত স্লোগান উঠেছিল জয়দেবপুরের পথ ধর- বাংলাদেশ স্বাধীন কর। উল্লেখ্য, ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্বেই ১৯ মার্চ ঐতিহাসিক জয়দেবপুরে শুরু হয়েছিল বাংলাদেশে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ।

এ জয়দেবপুর থেকেই গর্জে উঠেছিল পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য সরাসরি বন্দুকযুদ্ধ। তাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জয়দেবপুর তথা গাজীপুরবাসীর কৃতিত্বপূর্ণ এবং গৌরবময় ভূমিকা চির অম্লান। পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রথম গাজীপুরবাসীর অস্ত্র গর্জে ওঠে। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধকালীন নয় মাসের কঠিন আর কঠোর রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামে লাখো প্রাণের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা অর্জন করেছি বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। বিজয়ের তাৎপর্যে আজও গাজীপুরের জয়দেবপুরের স্মৃতি জাগ্রত চৌরঙ্গী সূর্যালোকের ন্যায় উজ্জ্বল হয়ে আছে আমাদের জাতীয় জীবনে।

১৯ মার্চ ঐতিহাসিক দিনগুলোর ঘটনা ব্যাপক এবং এর সূচনা ১ মার্চ থেকে। গাজীপুর রাজবাড়ীতে অবস্থান নিয়েছিল দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট। এ রেজিমেন্টে ৩০ জন ব্যতীত সবাই বাঙালি সৈনিক ও অফিসার ছিলেন। লে. কর্নেল মাসুদুল হোসেন খান ছিলেন দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক (সিও) এবং সহঅধিনায়ক ছিলেন মেজর শফিউল্লাহ। দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সবাই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন। ১৯৭১-এর ১৫ মার্চ ঢাকা সেনা সদর থেকে খবর আসে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের ৩০৩ কেলিবার রাইফেলগুলো সদর দফতরে জমা দেওয়ার জন্য। কিন্তু সদর দফতরে অস্ত্র জমা দিতে অস্বীকার করায় ১৯ মার্চ ঢাকার পাঞ্জাবিব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জাহানজের খান নিজেই অস্ত্র জমা নিতে আসেন। রাজবাড়ীতে পৌঁছেই দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সতর্কাবস্থা দেখেই পাক ব্রিগেডিয়ার জাহানজের খান হতাশ হয়ে পড়েন।

বিক্ষুব্ধরা জয়দেবপুরের চৌরাস্তা থেকে টঙ্গী মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৩০টি ব্যারিকেড স্থাপন করে। এদিকে চৌরাস্তায় বিক্ষুব্ধ জনতার মুহুর্মুহু স্লোগানে আকাশ-বাতাস যখন প্রকম্পিত তখন দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ৩ টনি ট্রাক টাঙ্গাইল থেকে জয়দেবপুরে ফিরছিল। ট্রাকে সিদ্দিকুর-এর নেতৃত্বে ৫ বাঙালি সৈনিক ছিলেন। তাদের প্রত্যেকের হাতে ছিল এসএমজি। জনগণের প্রতিরোধের মনোভাব বুঝতে পেরে তাদের সঙ্গে সৈনিকরা একাত্মতা ঘোষণা করে পাক সেনাদের সরাসরি গুলিবর্ষণ শুরু করেন। ফলে শুরু হয় পাল্টা গুলি। পাক সেনাদের বিরুদ্ধে এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র গুলিবর্ষণের ঘটনা।

জানা যায়, ‘জয়দেবপুরের পথ ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ স্লোগানে ১৯৭১-এর ১৯ মার্চ প্রথম পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন গাজীপুরের মানুষ। পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে দেশে এটিই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনার গুলিতে শহীদ হন হুরমত, নিয়ামত, কানু মিয়া ও মনু খলিফা। আহত হন শাহজাহান, সন্তোষসহ নাম না জানা আরও অনেকে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, যুদ্ধে শহীদ ও আহত বীরদের অসামান্য আত্মত্যাগ স্মরণে দেশের খ্যাতিমান ভাস্কর আবদুর রাজ্জাক তৈরি করেছিলেন এই দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যকর্ম। গাজীপুরের দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল আমীন আহম্মেদ চৌধুরী বীর বিক্রম ভাস্কর্যটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন। জাগ্রত চৌরঙ্গীর প্রকৌশলী ছিলেন আবদুর রশিদ। তাঁর সহকারী ছিলেন এম আহমদ ও আবদুল হক। নির্মাণ তত্ত্বাবধানে ছিলেন আসলুল হক ও আবদুল হক। ব্যবস্থাপনায় ছিলেন সুবেদার খন্দকার মতিউর রহমান বীর বিক্রম। আলোকসজ্জার দায়িত্বে ছিল গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড। ১৯৭২ সালে ভাস্কর্যটির নির্মাণকাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে। বেদিসহ জাগ্রত চৌরঙ্গীর উচ্চতা ৪২ ফুট ২ ইঞ্চি। ২৪ ফুট ৫ ইঞ্চি বেদির ওপর এটি স্থাপিত। উদোম গায়ে পেশিবহুল এক যুবক খালি পায়ে মাথা উঁচু করে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর ডান হাতে তাজা গ্রেনেড আর বাম হাতে রাইফেল। ভাস্কর্যটির দুপাশের ফলকে ১৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩ নম্বর সেক্টরের ১০০ এবং ১১ নম্বর সেক্টরের ১০৭ জন শহীদ সেনা ও মুক্তিযোদ্ধার নাম খোদাই করে লেখা আছে।

Facebook Comments Box

Posted ১১:০৮ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫

ajkersangbad24.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

সম্পাদক
ফয়জুল আহমদ
যোগাযোগ

01712000420

fayzul.ahmed@gmail.com